পৃথিবী কি একটি গ্রিন হাউস?
গ্রীন হাউস ইফেক্ট :
পরিবেশের আলোচনায় গত শতক থেকেই গ্রীন হাউস ইফেক্ট গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।পরিবেশ এই বিষয়টি এত গুরুত্বপূর্ণ যাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক কার্যাবলী তেও এই বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং একে কেন্দ্র করে কিছু রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়েছে যেমনঃ Green Place Green Party ইত্যাদি। গ্রীনহাউজ মূলত শীতপ্রধান দেশগুলো থেকে উদ্ভব হয়েছে। সবুজ উদ্ভিদ মানুষের প্রাথমিক বা মুখ্য উৎপাদক। এই সবুজ উদ্ভিদ জন্মাতে গেলে কিংবা সবুজ উদ্ভিদের নিজস্ব খাদ্য তৈরিতে সূর্যালোক মুখ্য উপাদান। সূর্যের একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ছাড়া উদ্ভিদ কখনো তার খাদ্য উৎপাদন করতে পারে না। কিন্তু শীতপ্রধান দেশে অতি নিম্ন তাপমাত্রার কারণে সেখানে সবুজ উদ্ভিদ জন্মাতে পারে না। কিন্তু সূর্যালোক উদ্ভাসিত অংশে কাচ দিয়ে ঘেরা ঘরের ভিতরে সবুজ উদ্ভিদ জন্মাতে পারে। এর কারণ হলো সূর্য থেকে আসা তাপ ক্ষুদ্র তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের এবং তা পৃথিবীপৃষ্ঠে আপাতিত হয়ে পরে প্রতিফলিত হয়। অধিকাংশ তাপ বিকিরিত হয়ে পুনরায় তা (প্রায় 75%) মহাশূন্যে ফিরে যায়। কাচের ধর্ম হলএর মধ্য দিয়ে ক্ষুদ্র তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো যেতে পারে। কিন্তু বড় তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো যেতে পারে না। শীতপ্রধান দেশে কাচের নির্মিত ঘরে সূর্যালোক থেকে আসা আলো সহজে প্রবেশ করতে পারে, কিন্তু পৃথিবীপৃষ্ঠে যখন আপাতত হয় তখন উহার তরঙ্গদৈর্ঘ্য বৃহদাকার হয়। এই বৃহৎ আকারে তরঙ্গদৈর্ঘ্য কাচ ভেদ করে আর বাইরে যেতে পারে না। ফলে কাচের ঘরের অভ্যন্তরে ক্রমশ সূর্যের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে ফলে অভ্যন্তরস্থ সবুজ উদ্ভিদ খাদ্য তৈরি করতে পারে এটাকে বলে গ্রীনহাউজ বা সবুজ ঘর আর কাচের দেয়াল এর জন্য যে অভ্যন্তরভাগ ঊষ্ণ হচ্ছে তাকে বলে গ্রীনহাউজ ইফেক্ট বা সবুজ ঘর প্রভাব ।
গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া অনেক উত্তাপ নিয়ে পৃথিবীতে পতিত হয়, এবং তা পৃথিবীপৃষ্ঠ হতে পুনরায় বিগলিত হয়। পৃথিবীকে ঘিরে O3 স্তর নিচে গ্রিনহাউস গ্যাসের স্তর বিদ্যমান। গ্যাসের এ স্তর ভেদ করে সম্পূর্ণ তাপ বের হতে পারে না। ফলে কিছু তাপ পৃথিবীপৃষ্ঠে থেকে যায়। এর ফলে পৃথিবী উত্তপ্ত থাকে। এটি অনেকটা কাঁচের তৈরি সবুজ ঘরের মটো। গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাবে পৃথিবীর উত্তপ্ত থাকার এই প্রভাবকে গ্রীন হাউস ইফেক্ট বলে। যে সমস্ত গ্যাস সমূহ গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে তাদেরকে গ্রিনহাউস গ্যাস বলে। যথাঃ CO2, CFC, N2O, CH4 ও অন্যান্য গ্যাস।
গ্রীন হাউজ গ্যাস সমূহের উৎস -----
- CO2: জীব শ্বসন প্রক্রিয়ায় সিওটু নির্গত করে কলকারখানা ও যানবাহন থেকে প্রচুর পরিমাণে সিওটু নির্গত হয়।
- CFC: রেফ্রিজারেটর, air-conditioner প্লাস্টিক রং এর কারখানা হতে সিএফসি গ্যাস নির্গত হয়।
- N2O: রাসায়নিক সার হতে N2O বিভিন্ন বিক্রিয়ার মাধ্যমে নির্গত হয়।
- CH4: বিভিন্ন পশু পাখির মল র্বং পচা জৈব পদার্থ থেকে ch4 নির্গত হয়।
গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়ার উৎস
পৃথিবীর পরিমন্ডলকে গ্রীনহাউজ রূপে কল্পনা করলে বায়ুমন্ডলের CO2 হলো পৃথিবীর গ্রীনহাউসের কাচের দেয়াল। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে CO2, CFC, N2O, CH4 গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে গেলে গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় সূর্যের রশ্মি বায়ুমণ্ডল ভেদ করে ভূপাতিত হতে পারে কিন্তু উত্তপ্ত বায়ুমণ্ডল থেকে বিকিরিত তাপশক্তি বায়ুমন্ডলের CO2 স্তর ও ওজোন স্তর ভেদ করে বাইরে যেতে পারে না। ফলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হয়ে পড়ে ও ওজোনস্তরে ফাটল ধরে। সূর্যের UV রশ্মি এই ফাটলের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে এসে জীব জগতের উপর প্রভাব ফেলে ও প্রাণের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়। পৃথিবীর প্রাণের অস্তিত্বের উপর তাপমাত্রা বৃদ্ধি জনিত এরকম বিরূপ প্রভাবকে গ্রীন হাউজ প্রভাব বলে।
পৃথিবী কি একটি গ্রিন হাউস?
পৃথিবীর নিজস্ব একটি বায়ুমণ্ডল রয়েছে। আর এই বায়ুমন্ডলে বিভিন্ন গ্যাস, যারা পৃথিবীর সামগ্রিক পরিবেশকে তথা বায়ুমন্ডলকে করছে নিয়ন্ত্রণ। বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন (O2), নাইট্রোজেন (N2), কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO2) ছাড়াও অন্যান্য গ্যাস। এসব বায়ুমন্ডলে রয়েছে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় বাসাম্যবস্থায়। এই নির্দিষ্ট মাত্রায় একটুখানি হেরফের হলেই বায়ুমন্ডলে তথা বিশ্বের আবহাওয়া মন্ডলে দেখা দেয় বিপর্যয়।
সূর্যালোক আসার পরে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে যখন বিকিরিত হয় বায়ুমণ্ডলের ভিতর দিয়ে মহাশূন্যে ফিরে যাওয়ার কথা তখন বায়ুমন্ডলে থাকা CO2 সহ বিভিন্ন গ্যাস এই তাপ কে ধরে রাখে। ফলে পৃথিবী হয় উত্তপ্ত। বায়ুমন্ডলে যখন CO2 সহ বিভিন্ন গ্যাস (যেমন: CH4, N2O, SO2, CFC ইত্যাদি) অধিকমাত্রায় বেড়ে যায় তখন তাপ বেশি করে ধরে রাখে ফলে বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হয়। যার প্রভাব সমগ্র আবহাওয়া মন্ডলের পড়ে এবং এর স্বাভাবিক অবস্থার বিপর্যয় ঘটে।
শিল্প বিপ্লবোত্তর পরিসরে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের মাত্রা ক্রমশ বেড়ে চলেছে আর এইসব জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বিভিন্ন গ্যাস যেমন: CH4, N2O, SO2, CFC ইত্যাদি উদগত হয়ে বায়ুমন্ডলে গিয়ে তাপমাত্রাকে ধরে রাখছে। ফলে পৃথিবী হচ্ছে উত্তপ্ত। ফলে পৃথিবী নিজেই এখন একটি বিশাল গ্রীন হাউস।
গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া ও বিশ্ব পরিবেশ---
পৃথিবীতে কোথাও অতিবৃষ্টি, কোথাও অনাবৃষ্টি মরুভূমিতে অতিবৃষ্টি, সমভূমিতে অনাবৃষ্টি। যেখানে বন্যার কথা কল্পনারও বাইরে সেইসব অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা, সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে হঠাৎ জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো , টাইফুন এর মত অতি ভয়ঙ্কর রূপ, লাল-সবুজ রঙের বৃষ্টি , অ্যাসিড বৃষ্টি ,ভূমন্ডলের উষ্ণায়ন , গাছের পাতার রং ফিকে হওয়া , ক্রমহ্রাসমান জীব-বৈচিত্র , শ্বেত শুভ্র পাহাড় পর্বত শুভ্রতা বিনষ্ট , মরুকরণ , ওজোন স্তরে বিশাল গহবর , শীতপ্রধান অঞ্চলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি , মহাসমুদ্রের অ্যাসিড বৃষ্টি , আরো হাজারো চিত্র আমাদের সামনে আজ প্রতিষ্ঠিত। যেগুলো অধিকাংশ ঘটছে আমাদের চোখের সামনে আবার সমানভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে। প্রকৃতির এই নিয়ম পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে গ্রিনহাউস গ্যাসের অবদান আমাদের সৃষ্টি। সৃষ্টি তখন সুন্দর হয়, যখন মানুষের কল্যাণের কাজে লাগে। গ্রীন হাউজ গ্যাস সৃষ্টি করছে মানুষের কারণে সার্বিক কল্যাণের নিমিত্তে। কল্যান হচ্ছে ঠিকই কিন্তু এই কল্যাণই প্রকৃতিতে অকল্যাণ বয়ে নিয়ে আসছে। এর ফলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে, যেমনঃ--
১। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিঃ
পৃথিবীর মোট 75 ভাগই জলরাশি এই বিশাল জলরাশি 97% সমুদ্র ধারণ করে। শিল্প বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত সমুদ্রের পানির পরিমাণ এ তেমন হ্রাস-বৃদ্ধি হয়নি। শিল্প বিপ্লবের পরে যে দিন থেকেই এইসব শিল্প-কারখানায় জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করা শুরু হয়, তখন থেকেই সমুদ্রতলের হ্রাস-বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। এর বায়ুতে যেসব গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হল বিশেষত CO2 যা ভূমণ্ডলীয় উত্তোলনের সহায়তা করে। যার প্রভাবে সমুদ্রতলের উচ্চতা বাড়ে। ভূমণ্ডলীয় উত্তপন যত বেশি হয় সমুদ্রতল তত বেশি উচ্চ হয়।
2 উপকূলীয় সমুদ্রতট ও দ্বীপসমূহের প্লাবনঃ
সমুদ্র উপকূলবর্তী প্রায় 75 মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার এলাকা ও তত্সংলগ্ন আবাসভূমি পানিতে তলিয়ে যাবে। পৃথিবীর প্রায় মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায়। ফলে তাদের বসবাসের স্থান হয়তো চিরস্থায়ীভাবে পানিতে ভেসে যাবে। মহাসাগরীয় দ্বীপসমূহ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইতিমধ্যে মালদ্বীপ ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল সমুদ্র পানিতে ডুবে আছে। পৃথিবীর যত বড় বড় বন্দর আছে তার সবই সমুদ্র উপকূলে অবস্থিিত। ফলে বন্দর গুলোর অবস্থা আরো শোচনীয় যার প্রভাব পড়বে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে।
৩. উপকূলবর্তী নদীর লবণাক্ততা বৃদ্ধিঃ
সমুদ্রের পানি লবণাক্ত। পানির উচ্চতা বাড়লে সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে আবাধে সমুদ্রের পানি ঢুকে যাবে। ফলে ঐ স্থানে বসবাসরত উদ্ভিদ, মৎস্য ক্ষেত্র, শস্য ক্ষেত্র প্রভৃতি বিনষ্ট হবে। একটি জরিপ মতে, এর ফলে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে গঙ্গা , আমাজন , মিসিসিপি , এবং ইয়াংসি নদীর।
৪.বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস বৃদ্ধিঃ
সমুদ্র স্তর বৃদ্ধির কারণে স্বাভাবিকভাবেই স্বাভাবিকের তুলনায় উচু জোয়ার হবে যা কখনো কখনো জলোচ্ছ্বাসের রূপ ধারণ করে। ফলে নিম্নাঞ্চলসমূহে নিয়মিত সমুদ্রসৃষ্ট বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস দেখা দিবে। আর এর সাথে সমুদ্র এ সাইক্লোন , ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হলে এই জলোচ্ছ্বাস তখন মারাত্মক রূপ ধারণ করবে, যাতে ব্যাপক জীবনহানি ঘটাবে।
৫. সমুদ্রের লবণাক্ততা বৃদ্ধিঃ
ব্রিটিশ Royal Society পরিচালিত গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে। সমুদ্র পরিবেশ থেকে CO2 শুষে নিয়ে পানির PH ভ্যালু কমায়। কিন্তু বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত CO2 বৃদ্ধির ফলে এই প্রক্রিয়াটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অতিরিক্ত CO2 সমুদ্রের পানিতে মিশে সেখানে তৈরি হচ্ছে কার্বনিক অ্যাসিড।The Intergovernmental Oceanographic Commission এর রিপোর্ট অনুযায়ী দৈনিক ২০-২৫ মিলিয়ন টন CO2 মহাসমুদ্রে মিশছে।
৬. এন্টার্কটিকার বর্তমান অবস্থাঃ
বিগত 30 বছরের গতি বৃদ্ধির হার ২৫% । একবিংশ শতাব্দীতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বেড়ে যাবে।
0 Comments